পটভূমি ও প্রেক্ষাপট

English, Hindi, Kannada, Malayalam, Telugu

অতিমারির সর্বনাশা দ্বিতীয় ঢেউ ইতিমধ্যে হাজার হাজার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। লক্ষ-লক্ষ মানুষ কোভিডের ফলস্বরূপ অন্যান্য নানান ব্যধিতে ভুগছেন। গতবছরের লকডাউনে প্রায় ১ কোটি মানুষ কর্মহীন হয়েছে, সেই সংখ্যা দ্বিতীয় ঢেঊয়ে আরও বাড়বে এমনই আশঙ্খা রয়েছে।
এক অদৃশ্য জরুরী অবস্থা নিঃশব্দে তার শক্তি অর্জন করে ভবিষ্যতে দরিদ্র মানুষের সমতা ও মর্যদাপূর্ণ জীবন-জীবিকার সুযোগ পাওয়াকে এক সঙ্কটের মুখে দাঁড় করাচ্ছে। এই জরুরী অবস্থা, শিক্ষার জরুরী অবস্থা। ইতিমধ্যে শিক্ষার নিম্ন গুণমানের জন্য অধিকাংশ ছেলেমেয়েরা কাঙ্খিত শিখন ও মৌলিক দক্ষতা অর্জনে অপারগ হয়েছে। কয়েকটি রাজ্য বাদ দিলে সরকারী শিক্ষাব্যবস্থা ভারতের প্রায় সবক’টি রাজ্যের একটা বড় অংশের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য গতবছর বিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ করেছিল, এই বছরও সেই সম্ভাবনা প্রকট। হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে তাদের মা-বাবার একজনকে অথবা দু’জনকেই হারিয়েছে। একইসঙ্গে লক্ষ-লক্ষ মানুষ তাদের রুটি-রুজি হারিয়ে, ছেলে-মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাবে না কাজের ক্ষেত্রে তাঁদের সাহায্য নেবে এই কঠিন সিদ্ধান্তের দোটানার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।

এই সময়ে বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি অনলাইনের মাধ্যমে পড়াশুনার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ‘ডিজিট্যাল টুল’ ও অ্যাপ যেগুলি ছাত্র-ছাত্রীদের টিউশানি, পরীক্ষার প্রস্তুতি ও বাড়ির কাজে সাহায্য করতে সক্ষম তাদের বাড়-বাড়ন্ত ছোখে পড়ার মত। এককথায় সর্বক্ষেত্রে শিক্ষায় বৈষম্য আরও বাড়ছে। একদিকে সরকারী বিদ্যালয়ে পড়া প্রান্তিক সমাজের ছেলে-মেয়েরা প্রায় দুই বছর ধরে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, আর অপরদিকে অভিজাত বেসরকারী বিদ্যালয়ে পড়া ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষার সুযোগ পেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

এইমুহুর্তে সরকারী শিক্ষাব্যবস্থার জন্য বেশকিছু বাস্তবসম্মত, নমনীয় পদক্ষেপ আমাদের নিতে হবে যা কার্যকরীভাবে শিক্ষা প্রদানে সাহায্য করবে। এই পদক্ষেপ অবশ্যই অতিমারীর পরিস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের বর্তমান অবস্থা ও সাম্ভাব্য সংক্রমনের ঢেউয়ের কথা মাথায় রেখে করতে হবে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রের জরুরী অবস্থা সামাল দিতে যেমন রাজ্যস্তর থেকে জেলাস্তরে ‘জরুরী নিয়ন্ত্রন কক্ষের’ ব্যবস্থা থাকে, ঠিক তেমনি শিক্ষার জরুরী অবস্থাকে সামাল দিতেও আশু ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। একথা মেনে নেওয়া অসঙ্গত হবেনা যে, সরকারী বিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে আজ ‘বিদ্যালয়ের বাইরে’।

  1. মূলতঃ দুটি পদক্ষেপের কথা ভাবতে হবে-

আগ্রহী ব্যক্তি, সংগঠন ও গোষ্ঠি গুলিকে চিহ্নিত করে আলোচনার মাধ্যমে একটি আলগা জোট তৈরি করতে হবে যা ‘ভারতে শিক্ষার জরুরী অবস্থাকে’ সামলানোর জন্য কাজ করবে। জোটের সদ্যস্যরা তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্ক ও পরিচিতির গণ্ডি থেকে নিয়মিত আগ্রহী ব্যক্তি ও সংগঠগনকে জোটে সামিল করতে সচেষ্ট থাকবেন। সরকারী দপ্তর যেমন – শিক্ষা দপ্তর, মহিলা ও শিশুকল্যান দপ্তর, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান দপ্তর, গ্রাম-বিকাশ দপ্তর এবং পঞ্চায়েত দপ্তরকে উৎসাহিত করতে হবে যাতে এই উদ্যোগের পাশে তাঁরা থাকেন।

2. দ্বিতয়ত, এই জোট মূলতঃ দুটি কর্মসূচি নেবে –

ক) সদস্যরা তাঁদের চিন্তা-ভাবনা, অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা উপকরণ চিহ্নত করে একে অপরের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক/বাস্তবসম্মত/উদ্ভাবনমূলক শিক্ষাপ্রকৌশলগুলি আদান-প্রদান করবেন, যাতে বিভিন্ন অঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীরা এর থেকে উপকৃত হয় এবং শিক্ষকদের কাছে এগুলি ধারাবাহিকভাবে পৌঁছায়।
খ) সরকারী ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্দেশ্যে ‘ওকালতি পত্র’ তৈরি করা। বিদ্যালয় খোলার নিয়মবিধি, ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা, খাদ্য ও পুষ্টি, পাঠক্রম ও পঠন-পাঠন এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠির অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়গুলিকে নিয়ে এই কাজ করতে হবে।

মূল নীতি

এই জোটের মূল নীতি সর্বার্থে ‘সাম্যে’প্রতিষ্ঠা করা। জোটের প্রাথমিক মাথাব্যথার কারণ হলো সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির কাছে পর্যাপ্ত সহায়তা না পৌঁছানো, যা নিরন্তর বৈষম্য তৈরি করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার সুবিধাকে সার্বজনীন করা যাতে কোনো শিশু শিক্ষার পরিধি থেকে ছেড়ে না যায়। যাদের উপর সর্বাধিক প্রভাব পড়তে পারে এমন দল যেমন – বালিকারা, তফশিলী জাতি/উপজাতি, ভাষা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, ভৌগলিকভাবে দূরবর্তী বা প্রায় বিচ্ছিন্ন এমন ছেলে-মেয়েদের প্রতি বিশেষভাবে নজর দেওয়া।

অন্যান্য যে বিষয়গুলিকে নীতিগতভাবে গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো – শিক্ষা-ব্যবস্থার সামগ্রিক নমনীয়তা বাড়ানো, বিকেন্দ্রিত পরিকল্পনা ও তার প্রয়োগ এবং সরকারী আর্থিক বিনিয়োগ সুনিশ্চিত করা।

আশু কর্মসূচি

  1. আগ্রহীদের নিয়ে একটি জোট তৈরি করা যা ‘শিক্ষার জরুরী অবস্থাকে’ সামলানোর ও চিন্তাভাবনা বিনিময়ের জন্য এক মঞ্চ হবে।
  2. রাজ্য, জেলা, ব্লক ও গুচ্ছস্তরের প্রতিষ্ঠানগুলিকে ‘শিক্ষা জরুরীকক্ষ’ হিসাবে সক্রিয় করা যাতে সব ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে শিক্ষার সুযোগ পৌঁছায়। এই বিষয়ে স্থানীয় সরকারী ও সমুদায়ভিত্তিক সংগঠন গুলিকে যুক্ত করা।
  3. উপযুক্ত পাঠক্রম পরিকল্পনা – যা উপকরণ তৈরি, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রস্তুতি, শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-শিক্ষকের মিথষ্ক্রিয়া এবং ধারাবাহিকভাবে বিদ্যালয় ও শিক্ষককে সহায়তা প্রদানের দ্বারা নিশ্চিত করতে হবে।
  4. সার্বজনীন ‘ডিজিট্যাল’ পরিকাঠামো তৈরি করা – আনুসঙ্গিক যন্ত্রপাতি ও ইন্টারনেটের সংযোগ এবং ছাত্র-ছাত্রী ও সমুদায়কে নিয়মিত ও পরিকল্পনা মাফিক পঠন-পাঠন সামগ্রী প্রদান।
  5. স্থানীয় স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ – বিদ্যালয় খোলার ব্যাপারে বিদ্যালয় পরিচালন সমিতি, পঞ্চায়েত বা স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশিকা অনুসারে স্থানীয় পরিবেশ-পরিস্থিতি ও সমস্যাগুলিকে যথাসম্ভব বিচার করে সিদ্ধান্ত নেবেন।
  6. বিদ্যালয় স্তরে প্রস্তুতি – শারিরিক দূরত্ববিধি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সংক্রমন নিয়ন্ত্রন, দুরত্ববিধি অনুযায়ী ছাত্র-ছাত্রীদের আসন বিন্যাস, হাত-পা ধোয়ার ব্যবস্থা, সাবান, স্যানিটাইজার ও থার্মাল স্ক্যানারের ব্যবস্থা করা, মধ্যাহ্নভোজন ও অতিরিক্ত পুষ্টির জন্য ব্যবস্থা, পুষ্টিকর খাবার ও সহায়ক উপাদান যেমন –ভিটামিন, আয়রন, কৃমিনাশক ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। স্বাস্থ্যপরীক্ষার সক্রিয় উদ্যোগ ও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী ও ছাত্র-ছাত্রীদের টিকাকরণ করার ব্যবস্থা।
  7. কোভিডের যত্ন – সংক্রমন বুঝতে পরীক্ষার সুবিধা, কোয়েরেন্টাইন, নিয়ন্ত্রিত এলাকা তৈরি করা ও স্বাস্থ্য সুবিধা প্রাপ্ত করা।
  8. উপযুক্ত পাঠ-উপকরণ চিহ্নিত করে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উৎসাহিত করা যাতে তাঁরা স্থানীয় সংস্করণ তৈরি করেন এবং অন্যান্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেন। এগুলি যাতে সম্পদভাণ্ডারে জমা থাকে এবং সবার জন্য সহজলভ্য হয় তাও নিশ্চিত করতে হবে। পাঠ্যবিষয়বস্তু ও দক্ষতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে সামাজিক ও আবেগ জনিত স্থিতবস্থা আনার দিকে জোর দিতে হবে।
  9. শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রস্তুতি – পাঠ্যসূচি সমন্ধে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গী, বিষয়বস্তুর অগ্রাধিকার তৈরি করা, পুনরালোচনা, প্রস্তুতি ও দরকারি বিষয়বস্তুর পুনরভ্যাস করার ব্যবস্থা। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে ডিজিট্যাল ও মিডিয়া সাক্ষরতা তৈরি করা যাতে প্রয়োজনে অনলাইন শিক্ষণ কার্যকরিভাবে পরিচালনা করতে পারেন। সময়ে সময়ে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য অন্ত ও আন্তরাজ্য ‘ওয়েবিনার’ আয়োজন করা যাতে এক জায়গার সফল কর্মসূচি অন্য জায়গায় প্রয়োগ করা যায়।
  10. ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠিত শিখনে সহায়তা দান – বিদ্যালয়ে ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাঠ উপকরণ ও সংগঠিত নির্দেশিকা প্রদান, ছোট ছোট দলে ছাত্র-ছাত্রীদের (বিভিন্ন বয়সের একসঙ্গেও হতে পারে) পাঠদানের সুযোগ দেওয়া। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেকদের কাজে লাগিয়ে ছোট দলে জনগোষ্ঠির মধ্যে খোলামেলা জায়গায় পাঠ অভ্যাস করানো। অভিভাবক তথা জনগোষ্ঠির সাহায্য নেওয়া। বিদ্যালয়কে জনগোষ্ঠির প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেখা এবং স্থানীয় মানুষদের ধারাবাহিকভাবে শিক্ষক ও বিদ্যালয় দ্বারা নিরাপত্তা ও সংক্রমনের ঝুঁকি নিয়ে বার্তা পাঠানোর ব্যবস্থা করা । মূল্যায়ণের ব্যবস্থা শুধু সহায়তা প্রাপ্ত শিখনের জন্য করা দরকার।
  11. সরকারী ব্যয় বরাদ্দ – বিদ্যলয় প্রস্তুতি – বিদ্যালয়ে জল ও স্বাস্থ্যবিধি পালনের ব্যবস্থা, সকালের ও দুপুরের পুষ্টিকর খাবার প্রদান, ছাত্র-ছাত্রীদের অনলাইনের ‘ডিভাইস’ এর সাহায্য প্রদান ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র প্রদান।
  12. গণপ্রচার মাধ্যমে প্রচার – মুদ্রণ, সামাজিক মাধ্যম, বেতার ও টিভিতে নিয়মিত তথ্য, রণকৌশল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিদ্যালয়, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও জনগোষ্ঠির জন্য প্রচার করা যাতে সুবিধার সর্বাপেক্ষা সদ্‌ব্যবহার করা যায়।

অধিক তথ্যের জন্য লিখুন – info [at] educationemergency [dot] net